রাত তখন গভীর। পৃথিবী নিস্তব্ধ। আপনি হয়তো মাত্রই একটু চোখের পাতাটা এক করেছেন, ঠিক তখনই সেই চেনা শব্দ—"ওয়া ওয়া ওয়া!"। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। আবার শুরু হলো যুদ্ধ। বাচ্চার কান্না।
নতুন বাবা-মায়ের জীবনে ঘুম জিনিসটা যেন এক সোনার হরিণ। আমাদের দেশে বাচ্চার কান্না মানেই আমরা সাধারণত দুটো জিনিস বুঝি—এক, বাচ্চার খিদে পেয়েছে; আর দুই, বাচ্চার ডায়াপার ভিজে গেছে বা পটি করেছে। নানি-দাদিরা হয়তো বলবেন, "নজর লেগেছে" বা "পেটে গ্যাস হয়েছে"। কিন্তু এর বাইরেও যে বাচ্চার কান্নার পেছনে গভীর কিছু সাইকোলজিক্যাল এবং ফিজিক্যাল কারণ থাকতে পারে, তা আমরা অনেকেই জানি না বা খেয়াল করি না।
২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে প্যারেন্টিং এখন আর শুধু অনুমানের ওপর চলে না। বিজ্ঞান এবং শিশু মনস্তত্ত্ব এখন অনেক উন্নত। আপনি কি জানেন, বাচ্চার কান্না আসলে তার ভাষা? সে যখন কথা বলতে পারে না, তখন কান্নাই তার একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। কিন্তু সব কান্নার মানে "আমাকে দুধ দাও" নয়। অনেক সময় আমরা না বুঝেই বাচ্চাকে জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করি বা কোলে নিয়ে ঝাঁকাতে থাকি, যা হিতে বিপরীত হয়।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা এমন ৬টি কারণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যা হয়তো আপনি প্রতিনিয়ত ইগনোর করছেন বা বুঝতেই পারছেন না। এই কারণগুলো জানলে হয়তো আপনার এবং আপনার সোনামণির রাতের ঘুমটা একটু শান্তির হতে পারে।
১. অতি ক্লান্তি (Overtiredness): ঘুম না আসার অদ্ভুত প্যারাডক্স
শুনতে খুব অদ্ভুত লাগছে, তাই না? বাচ্চা ক্লান্ত হলে তো টুপ করে ঘুমিয়ে পড়ার কথা! কিন্তু শিশুদের শরীর আমাদের মতো নয়। এটাই বাচ্চার ঘুমের সবচেয়ে বড় ট্র্যাপ বা ফাঁদ।
যখন একটি শিশু তার জেগে থাকার নির্দিষ্ট সময়সীমা (Wake Window) পার করে ফেলে এবং খুব বেশি ক্লান্ত হয়ে যায়, তখন তার শরীর এক ধরনের স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ করে, যার নাম কর্টিসল (Cortisol) এবং অ্যাড্রেনালিন। এই হরমোনগুলো বাচ্চাকে কৃত্রিমভাবে "এনার্জেটিক" বা সজাগ করে তোলে। অনেকটা আমরা বড়রা যেমন রাতে কফি খেলে আর ঘুমাতে পারি না, ঠিক তেমনই।
লক্ষণ:
বাচ্চা ঘুমানোর বদলে হাইপার হয়ে যাচ্ছে বা খুব হাত-পা ছুঁড়ছে।
চোখ ডলছে, কান টানছে কিন্তু ঘুমাচ্ছে না।
ঘুমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু বারবার চমকে জেগে উঠছে।
সমাধান:
বাচ্চাকে "ওভারটায়ার্ড" হতে দেবেন না। বাচ্চার বয়সের ওপর ভিত্তি করে তার জেগে থাকার সময়টা খেয়াল রাখুন। যেমন, নবজাতক হয়তো ৪৫ মিনিটের বেশি জাগলেই ক্লান্ত হয়ে যায়। বাচ্চা হাই তোলার আগেই তাকে ঘুমের পরিবেশ দিন। একবার কর্টিসল রিলিজ হয়ে গেলে তাকে শান্ত করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।
২. তাপমাত্রার হেরফের: খুব গরম বা খুব ঠান্ডা
আমাদের দেশে বাবা-মায়েদের (এবং মুরুব্বিদের) একটা খুব কমন প্রবণতা হলো বাচ্চাকে খুব বেশি মুড়িয়ে রাখা। "বাচ্চা ঠান্ডা লেগে যাবে"—এই ভয়ে আমরা ফ্যান বন্ধ রাখি, বা গরমের দিনেও কাঁথা মুড়িয়ে রাখি। কিন্তু জানেন কি? ঠান্ডার চেয়ে "ওভারহিটিং" বা অতিরিক্ত গরম বাচ্চার জন্য বেশি বিপদজনক এবং অস্বস্তিকর।
আবার উল্টোটাও হতে পারে। হয়তো এসি চলছে, বাচ্চার গায়ে পাতলা কাপড়, তার শীত লাগছে। বাচ্চারা তাদের শরীরের তাপমাত্রা বড়দের মতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
কীভাবে বুঝবেন?
বাচ্চার হাত বা পা ধরে তাপমাত্রা বোঝার চেষ্টা করবেন না। কারণ শিশুদের হাত-পা প্রাকৃতিকভাবেই একটু ঠান্ডা থাকে। তাপমাত্রা বোঝার সঠিক জায়গা হলো বাচ্চার ঘাড়ের পেছনের অংশ বা বুক।
যদি ঘাড়ের কাছে ঘাম থাকে বা খুব গরম লাগে, তার মানে সে ওভারহিটেড।
যদি বুক একদম ঠান্ডা মনে হয়, তবে তাকে আরেকটা লেয়ার কাপড় পরান।
সমাধান:
বাচ্চার ঘরের তাপমাত্রা সহনীয় রাখুন (সাধারণত ২২-২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস আদর্শ ধরা হয়)। সুতির আরামদায়ক কাপড় পরাতে হবে। মনে রাখবেন, আপনি যা পরে আরাম পাচ্ছেন, বাচ্চা তার চেয়ে বড়জোর একটা লেয়ার বেশি পরতে পারে, তার বেশি নয়।
৩. সেন্সরি ওভারলোড (Sensory Overload): দিনের বেলার উত্তেজনা
ভাবুন তো, আপনি সারাদিন একটা রক কনসার্টে ছিলেন, যেখানে প্রচুর আলো, শব্দ এবং মানুষের ভিড়। রাতে বাসায় ফিরে কি আপনি সাথে সাথে ঘুমাতে পারবেন? নাকি আপনার কানে সেই শব্দ বাজবে এবং মাথা ঝিমঝিম করবে?
বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও ঠিক এটাই ঘটে।
শিশুদের মস্তিষ্ক স্পঞ্জের মতো। তারা সারাদিন যা দেখে, যা শোনে—সব শুষে নেয়। যদি দিনের বেলা বা সন্ধ্যার দিকে বাচ্চাকে খুব বেশি স্ক্রিন (টিভি/মোবাইল) দেখানো হয়, খুব জোরে মিউজিক বাজানো হয়, বা অনেক আত্মীয়-স্বজন এসে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে চটকায়—তবে বাচ্চার মস্তিষ্ক "ওভার-স্টিমুলেটেড" হয়ে যায়।
লক্ষণ:
বাচ্চা কোনো কারণ ছাড়াই ঘ্যানঘ্যান করবে।
আলো বা শব্দের দিকে তাকালে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
রাতে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে উঠবে।
সমাধান:
ঘুমের অন্তত ১-২ ঘণ্টা আগে থেকে ঘরের আলো কমিয়ে দিন (ডিম লাইট ব্যবহার করুন)। টিভি বা মোবাইল বন্ধ রাখুন। উচ্চলয়ের খেলাধুলা বন্ধ করে শান্ত কোনো অ্যাক্টিভিটি করুন, যেমন—গল্প বলা বা পিঠে হাত বুলিয়ে দেওয়া। একে বলা হয় "Wind Down Routine"।
৪. ডেভেলপমেন্টাল লিপ বা মস্তিষ্কের বিকাশ (Wonder Weeks)
মাঝে মাঝে দেখবেন, বাচ্চা খুব ভালো ঘুমাচ্ছিল, হঠাৎ করে ৩-৪ দিন ধরে রাতে ১০ বার ঘুম ভাঙছে। আপনি দিশেহারা হয়ে যাচ্ছেন। এর কারণ হতে পারে বাচ্চা কোনো নতুন দক্ষতা শিখছে।
শিশুরা যখন কোনো নতুন ফিজিক্যাল বা মেন্টাল স্কিল শেখে—যেমন উপুড় হওয়া (rolling), বসা, হামাগুড়ি দেওয়া বা কথা বলা শেখা—তখন তাদের মস্তিষ্ক ঘুমের মধ্যেও সেই প্র্যাকটিস চালিয়ে যায়। ধরুন, আপনার বাচ্চা আজই প্রথম উপুড় হতে শিখেছে। রাতে ঘুমের মধ্যে সে অজান্তেই উপুড় হয়ে যাবে এবং ভয় পেয়ে কেঁদে উঠবে কারণ সে জানে না কীভাবে আবার সোজা হতে হয়।
লক্ষণ:
ঘুমানোর সময় বিছানায় প্রচুর নড়াচড়া করা।
ঘুমের মধ্যে কথা বলার চেষ্টা করা বা শব্দ করা।
হঠাৎ করে ঘুমের রুটিন বদলে যাওয়া।
সমাধান:
এটা একটা টেম্পোরারি ফেজ। এই সময় বাচ্চাকে একটু বেশি সময় দিতে হয়। তাকে দিনে প্রচুর ফ্লোর টাইম বা খেলার সুযোগ দিন যাতে সে নতুন স্কিলটা প্র্যাকটিস করে ক্লান্ত হতে পারে। রাতে ঘুম ভাঙলে তাকে শান্ত করে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিন, তবে এই সময় নতুন কোনো খারাপ অভ্যাস (যেমন কোলে নিয়ে হাঁটা) তৈরি করবেন না।
৫. সেপারেশন অ্যানজাইটি (Separation Anxiety): মা কোথায় গেল?
সাধারণত ৬-৮ মাস বয়সের পর থেকে এই সমস্যাটা শুরু হয় এবং ১৮ মাস পর্যন্ত চলতে পারে। এই বয়সে বাচ্চারা "Object Permanence" বা বস্তুর স্থায়িত্ব বুঝতে শেখে। অর্থাৎ, তারা বুঝতে পারে যে মা বা বাবা চোখের আড়াল হলেও তাদের অস্তিত্ব আছে।
এর আগে বাচ্চা ভাবত, মা চলে গেছে মানে মা আর নেই। কিন্তু এখন সে বোঝে মা পাশের রুমেই আছে, কিন্তু তার কাছে নেই। রাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙলে যখন সে দেখে মা পাশে নেই বা তাকে কোলে নিয়ে নেই, সে ভয় পেয়ে যায়। সে ভাবে তাকে একা ফেলে দেওয়া হয়েছে।
লক্ষণ:
আপনি রুম থেকে বের হতে গেলেই কান্না শুরু করে।
রাতে ঘুম ভাঙলে আপনাকে জড়িয়ে ধরতে চায়।
বিছানায় শুইয়ে দিলেই কান্না শুরু করে, কোলে নিলে চুপ।
সমাধান:
লুকোচুরি খেলা বা "Peek-a-boo" খেলুন, এতে বাচ্চা বুঝবে অদৃশ্য হলেও মানুষ ফিরে আসে। রাতে বাচ্চার কাছে গিয়ে তাকে স্পর্শ করুন, নিচু স্বরে কথা বলুন, কিন্তু সাথে সাথে কোলে তুলে নেবেন না। তাকে আশ্বস্ত করুন যে আপনি পাশেই আছেন।
৬. সাইলেন্ট রিফ্লাক্স বা পেটের অস্বস্তি
আমরা গ্যাস বা কলিক (Colic) সম্পর্কে জানি, কিন্তু "সাইলেন্ট রিফ্লাক্স" অনেকেই বুঝি না। সাধারণ রিফ্লাক্সে বাচ্চা বমি করে দেয়। কিন্তু সাইলেন্ট রিফ্লাক্সে পাকস্থলীর এসিড বা খাবার খাদ্যনালীতে উঠে আসে কিন্তু আবার নিচে নেমে যায়, বমি হয়ে বের হয় না। এতে বাচ্চার বুক ও গলায় প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া হয়। শোয়ালে এই ব্যথা বাড়ে, তাই বাচ্চা রাতে শুতে চায় না।
এছাড়াও, সলিড খাবার শুরু করার পর বাচ্চার হজমে সমস্যা হতে পারে। হয়তো কোনো নির্দিষ্ট খাবার (যেমন—গরুর দুধ, গমের তৈরি খাবার) তার পেটে গ্যাস তৈরি করছে যা আপনি বুঝতে পারছেন না।
লক্ষণ:
বাচ্চা খেতে চায় না বা খেতে খেতে পিঠ বাঁকিয়ে (Arching back) কান্না করে।
শুইয়ে দিলেই কান্না শুরু করে, খাড়া করে রাখলে আরাম পায়।
মাঝেমধ্যে কাশির মতো শব্দ করে বা হেঁচকি তোলে।
সমাধান:
খাওয়ানোর পর বাচ্চাকে অন্তত ২০-৩০ মিনিট খাড়া করে রাখুন। বুকের দুধ বা ফর্মুলা খাওয়ার পর অবশ্যই ভালো করে ঢেকুর তোলান। যদি সন্দেহ হয়, তবে ডাক্তারের পরামর্শে বাচ্চার ডায়েট পরিবর্তন করুন বা এসিড কমানোর ব্যবস্থা নিন।
উপসংহার: ধৈর্যই যখন একমাত্র চাবিকাঠি
বাচ্চা লালন-পালন করা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি। রাতে যখন ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসে আর বাচ্চা কেঁদে ওঠে, তখন মেজাজ খারাপ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু মনে রাখবেন, বাচ্চার এই কান্না আপনাকে বিরক্ত করার জন্য নয়। সে আপনাকে ডাকছে কারণ আপনিই তার একমাত্র ভরসার জায়গা।
ওপরের ৬টি কারণ চেকলিস্ট হিসেবে ব্যবহার করুন।
১. সে কি খুব ক্লান্ত?
২. তার কি গরম বা ঠান্ডা লাগছে?
৩. সে কি ওভার-স্টিমুলেটেড?
৪. সে কি নতুন কিছু শিখছে?
৫. সে কি আপনাকে খুঁজছে?
৬. তার পেটে কি কোনো অস্বস্তি হচ্ছে?
যদি সব চেক করার পরেও কান্না না থামে, তবে বাচ্চার ডাক্তারের পরামর্শ নিন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একটু সচেতনতা আর রুটিনে সামান্য পরিবর্তন আনলেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। আজকের এই রাতজাগা পাখিটিই একদিন বড় হয়ে আপনার ঘর আলো করবে, তখন এই নির্ঘুম রাতগুলো শুধুই স্মৃতি হয়ে থাকবে।